সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি শহর ও গ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার এক সামাজিক মহামারীর আকার ধারণ করেছে। তারা কেবল কোনো অপরাধের খবর নয়, বরং আমাদের সমাজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক গভীর সমস্যার প্রতিচ্ছবি। স্কুলড্রেস পরে দলবেঁধে ইভ টিজিং, সামান্য কথায় মারামারি, প্রকাশ্যে মাদক সেবন, কিংবা টিকটকে নিজেদের ‘বস’ হিসেবে তুলে ধরা—এই সব কিছুই যেন তাদের এক অজানা অস্থিরতা ও শূন্যতাকে তুলে ধরে।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষ এই সমস্যাকে কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা হিসেবে দেখে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন একটি শিশু বা কিশোর, যে পরিবার ও সমাজ থেকে ভালোবাসা ও ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা পাওয়ার কথা, সে কেন গ্যাং নামের একটি অন্যায়ের পথে পা বাড়াচ্ছে? এটা কি কেবলই বাহ্যিক সম্মান ও ক্ষমতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে তার মনের গভীরে জমে ওঠা দীর্ঘস্থায়ী একাকিত্ব ও অবহেলার ক্ষত? এই প্রবন্ধটি সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার একটি প্রচেষ্টা।
কৈশোর হচ্ছে জীবনের এমন এক সন্ধিক্ষণ, যখন একজন মানুষ নিজের পরিচিতি খুঁজে ফেরে। এই বয়সে অধিকাংশ শিশু কিশোরের ভেতরে একটি আকাঙ্ক্ষাই তীব্র থাকে—‘আমিও কিছু একটা হতে চাই, আমাকে সবাই চিনুক, আমার একটা আলাদা পরিচয় থাকুক’। যখন কোনো কিশোর ভালো ফল করে বা খেলাধুলায় ভালো করে তখন তারা সবার কাছ থেকে একধরনের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু সবাই তো পড়াশোনা কিংবা খেলাধুলায় পারদর্শী নয়। তাই কিছুটা পিছিয়ে পড়া শিশু কিশোররাই নিজেদের প্রকাশ করতে তখন বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে। আর ঠিক এই দুর্বল জায়গাটাতেই গ্যাং কালচার প্রবেশ করে।
একজন কিশোর যখন দেখে, গ্যাং-এ যোগ দিলে তাকে দলনেতা ‘সম্মান’ করছে, তার কথায় অন্যরা ভয় পাচ্ছে, তখন এই কৃত্রিম স্বীকৃতির নেশায় সে ধীরে ধীরে ডুবে যায়। এটি তার কাছে হিরো হওয়ার এক সহজ পথ মনে হয়। পড়াশোনা বা খেলাধুলায় ভালো না হয়েও সে হঠাৎ করেই নিজের এলাকার ‘বস’ বা ‘লিডার’ হয়ে উঠতে পারে। এই অনুভূতিটি তার আত্মবিশ্বাসকে এমনভাবে বাড়িয়ে দেয় যে সে তার ভুল পথটাকে আর ভুল মনে করে না।
ফেসবুক বা টিকটকে কিছু গ্যাং নিজেদের ‘বস’ বা ‘ডন’ হিসেবে তুলে ধরে, তাদের মারামারির ভিডিও প্রকাশ করে, যা দেখে অন্য কিশোররা প্রভাবিত হয়। তারা হলিউড বা বলিউড সিনেমার নায়কদের মতো করে নিজেদের উপস্থাপন করে, আর ভাবে, সহিংসতা মানেই ‘পাওয়ার’। যেহেতু তাদের সামনে বাস্তব জীবনে কোনো ইতিবাচক আদর্শ বা রোল মডেল নেই, তাই তারা এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার নকল হিরোদেরকেই অনুসরণ করতে শুরু করে। এই মাধ্যমগুলো তাদের কাছে অপরাধকে ‘স্টাইলিশ’ বা ‘কুল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, যা তাদের গ্যাংয়ে যোগ দিতে উৎসাহিত করে।
গবেষণা বলছে, যে কিশোররা গ্যাং বা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে, তাদের বেশিরভাগই আসলে পরিবারে অবহেলা বা মানসিক সহিংসতার শিকার। বাবা-মা হয়তো সন্তানের সব চাহিদা পূরণ করছেন—ভালো প্রাইভেট টিউটর, দামি কোচিং, নতুন স্মার্টফোন, ব্র্যান্ডেড পোশাক। কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিসটা, সেই ‘সময়’ আর ‘ভালোবাসা’ তারা দিতে পারছেন না। ফলে সন্তান ভেতরে ভেতরে একাকিত্বে ভোগে এবং বাইরের জগতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা খুঁজতে বাধ্য হয়।
মনের ভেতরে জমে থাকা দুঃখ, অপমানবোধ বা শূন্যতা তাদের ‘খুব শক্তিশালী’ হতে বাধ্য করে, যাতে আর কেউ তাদের অবহেলা না করতে পারে। গ্যাংয়ের শিল্পিত বন্ধুত্ব ও একধরনের বিকৃত সম্মান তাকে সাময়িকভাবে সেই অভাব পূরণ করার অনুভূতি দেয়। এটি এক ধরনের কিশোর মানসিকতার প্রতিক্রিয়া—“যদি কেউ ভালোবেসে আমাকে স্বীকৃতি না দেয়, আমি ভয় দেখিয়ে সেই স্বীকৃতি আদায় করব।” এই মানসিকতা তাকে ক্রমাগত অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়, কারণ প্রতিটি নতুন অপরাধ যেন তার কাছে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করার একটি উপায়।
পরিবারে যথাযথ দিকনির্দেশনা ও খোলাখুলি কথা বলার পরিবেশ না থাকাটাও বড় একটি কারণ। যখন একজন কিশোর তার মনের কথা বাবা-মা বা অন্য কোনো বিশ্বস্ত মানুষের সাথে বলতে পারে না, তখন তার মনে জমে থাকা কষ্টগুলো একসময় বিস্ফোরিত হয়। অনেক সময় হতাশা ও রাগ থেকে তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে, যা তাদের অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
এই কিশোররা প্রথম দিকে হয়তো শুধু দলবেঁধে ঘুরাঘুরি বা ইভ টিজিং করে। এরপর আসে মাদক সেবন এবং ছোটখাটো ছিনতাই। ধীরে ধীরে তারা অনুভব করে, ‘ভয় দেখানো’ই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এরপর শুরু হয় অস্ত্র বহন, মারামারি, চাঁদাবাজি কিংবা বড় ধরনের অপরাধ। এই পর্যায়ে এসে তারা গ্যাং থেকে বের হতে চাইলেও পারছে না—কারণ ‘পিয়ার প্রেসার’ (Peer Pressure) এবং দল ছাড়লে আক্রমণের ভয়। এই চক্র তাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিলেও, বাহ্যিকভাবে সে নিজেকে “পাওয়ারফুল” ভাবতে থাকে—যা এক ধরনের মানসিক আত্মরক্ষার কৌশল। সে তার ভুল পথটাকে সঠিক প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: শুধু আইন নয়, দরকার ভালোবাসা
এই সমস্যার সমাধান কেবল আইন দিয়ে করলে তা হবে টেম্পোরারি সমাধান। এটি স্থায়ীভাবে দূর করতে হলে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
পরিবারের প্রথম কাজ হলো সন্তানকে ‘শোনা’ এবং তাকে ‘সম্মান’ করা। সন্তান ভুল করলেও জানতে হবে কেন সে এমনটা করল। প্রতিটি শিশুরই প্রয়োজন একটি নিরাপদ মানসিক আশ্রয়। বাবা-মাকে সন্তানের সাথে নিয়মিত কথা বলতে হবে, তার বন্ধু-বান্ধবদের বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে এবং তার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর রাখতে হবে।
স্কুল-কলেজে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, নৈতিক ও মানবিক শিক্ষাদানের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিভিন্ন সেবামূলক কাজে কিশোরদের যুক্ত করলে তারা বিকল্প পরিচয়ের সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে তারা জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারে।
পাড়া-মহল্লাভিত্তিক “কমিউনিটি ক্লাব”, লাইব্রেরি, কাউন্সেলিং সেন্টার থাকলে কিশোররা অন্তত একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম পায় হৃদয়ের কথা বলার জন্য। কমিউনিটির মুরব্বীরা এবং শিক্ষকরা এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমে কিশোরদের জন্য রোল মডেল হিসেবে কাজ করতে পারেন।
পুলিশি অভিযান কিংবা আইন প্রয়োগের পাশাপাশি কিশোর অপরাধীদের মানসিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকেই হয়তো ভুল করেছে—কিন্তু সব মানুষেরই পুনর্গঠনের সুযোগের দাবি থাকে। সরকারের উচিত কিশোর অপরাধের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করা, যেখানে তাদের মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষারও ব্যবস্থা থাকবে।
আশা ও ভালোবাসার শক্তি
অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোরটি আসলে প্রথমে একজন সন্তান, একজন মানুষ। সেও কোনো এক সময়ে ভালোবাসা ও আশ্রয় খুঁজেছে। তাই কিশোর গ্যাং সমস্যাকে কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা হিসেবে ভাবলে হবে না, এটি হৃদয়ের খিদেও।
যদি আমরা কিশোরদের ভেতরের শূন্যতা পূরণ করতে না পারি, তারা সবসময় বাহ্যিক স্বীকৃতির জন্য গ্যাং, মাদক, সহিংসতার মতো ভুল পথেই যাবে। তাই সমাজের প্রতিটি অভিভাবক, শিক্ষক, আলেম, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীর সম্মিলিত ভূমিকা প্রয়োজন।
ঠিক তাই—কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো শিক্ষা নয়, বরং ভালোবাসা, দিকনির্দেশনা এবং মানসিক সমর্থন।