বাংলাদেশের ছোট-বড় শহরগুলোতে বর্তমানে পরিবহনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নিয়েছে মিশুক, ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। একদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকা নির্বাহের হাতিয়ার হিসেবে এই যানবাহনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে লাইসেন্সবিহীন ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রধান প্রধান সড়কে চলাচলের কারণে নগরবাসীর নিত্যদিনের ভোগান্তি, দুর্ঘটনা এবং যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন জাগে—এই যানবাহনগুলো শহরের প্রধান সড়কে কীভাবে এবং কেন চলাচল করছে, এবং এগুলোকে কি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না?
কেন প্রধান সড়কে মিশুক-ইজিবাইক? শহরে গণপরিবহনের ঘাটতি, যাত্রীদের সহজলভ্য যাতায়াত ব্যবস্থা, এবং মালিক-শ্রমিকদের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট—এই তিনটি প্রধান কারণে মিশুক ও ইজিবাইক আজ শহরের প্রধান সড়কে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ বাস বা মিনিবাসের ভিড় এড়িয়ে সহজ, দ্রুত ও সস্তা যাতায়াতের জন্য ইজিবাইক বেছে নিচ্ছে। অপরদিকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বা মালিক লাইসেন্স ছাড়াই শত শত ইজিবাইক নামিয়ে দিয়েছে রাস্তায়। প্রশাসনের চোখের সামনেই এরা যাত্রী উঠানো-নামানোর নামে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যানজট সৃষ্টি করছে।
কিভাবে প্রধান সড়কে আসে এই যানবাহনগুলো?বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নীরব সম্মতি কিংবা প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণেই ইজিবাইকগুলো প্রধান সড়কে চলাচল করছে। অনেক সময় দেখা যায়, পুলিশের চেকপোস্ট পার হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। একদিকে অরাজনৈতিক ট্রান্সপোর্ট কমিটি, অন্যদিকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া—সব মিলিয়ে এই খাত একটি অঘোষিত বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে, লাইসেন্সবিহীন ও সড়ক অযোগ্য যানবাহনও নির্দ্বিধায় রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পর্যন্ত ছুটে চলতে পারছে।
সমস্যার বহুমাত্রিক প্রভাব -১. দুর্ঘটনার ঝুঁকি: চালকরা অধিকাংশই অপ্রশিক্ষিত। তারা ট্রাফিক আইন জানে না, হেলমেট বা সিগন্যাল মানার অভ্যাস নেই। ফলে সড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। ২. যানজট: প্রধান সড়কে ধীরগতির ইজিবাইক চলার কারণে বড় যানবাহনগুলো বাধ্য হয়ে গতি কমায়, এতে সার্বিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি: যানজটে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার উৎপাদনশীল সময় নষ্ট হচ্ছে। ৪. পরিবেশগত সমস্যা: অনেক ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের চার্জার অবৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহার হওয়ায় বিদ্যুতের অপচয় এবং পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সমাধান কোথায়?-লাইসেন্স প্রদান ও নিবন্ধন: প্রতিটি ইজিবাইককে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশন, চালকদের প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিশ্চিত করতে হবে।
সড়কভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ: প্রধান সড়কের পরিবর্তে গলিপথ, অভ্যন্তরীণ রুটে ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
গণপরিবহন উন্নয়ন: পর্যাপ্ত ও সাশ্রয়ী বাস-সার্ভিস চালু করা গেলে মানুষ ইজিবাইকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হবে না।
আইন প্রয়োগ: পুলিশ ও প্রশাসনকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত থেকে কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।
শহরের প্রধান সড়কগুলোতে লাইসেন্সবিহীন মিশুক ও ইজিবাইক চলাচল শুধু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে অচল করছে না, বরং মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থা যদি এখনই এগুলো নিয়ন্ত্রণে না আনে, তবে সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বোঝা আরও বাড়বে। মানুষের যাতায়াত সুবিধা যেমন প্রয়োজন, তেমনি নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখন সময় এসেছে সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার—অন্যথায় এই সড়ক বিশৃঙ্খলা আগামী দিনে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।